প্রকার দাশগুপ্তের পদ্মশ্রী প্রাপ্তিতে সম্বর্ধনা দিল কলকাতার অ্যাপেলো হাসপাতাল

:
শ্রীজিৎ চট্টরাজ – কলকাতা
সাড়ে সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি। রবি কবি যে বাঙালির সমালোচনা করেই কবিতাটি লিখেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সেই বাঙালিদের কেউ কেউ যখন সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বিজয় সিংহের সিংহল জয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটান তখন তা খবর হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক কালে এমনই এক অঘটন ঘটিয়েছেন প্রবাসী বঙ্গতনয় ডা প্রকার দাসগুপ্ত। শনিবারের বারবেলায় পূর্ব কলকাতার বাইপাসের ধারে অ্যাপেলো মাল্টিসুপারস্প্যেশালিটি হাসপাতালের তরফে এক সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। ব্রিটেন প্রবাসী কিংবদন্তি ইউরোলজি বিভাগের শল্য চিকিৎসক প্রকার দাশগুপ্ত বছরে অন্তত দু তিনবার কলকাতায় এসে এই হাসপাতালের কিছু সমস্যাসঙ্কুল রোগীর অপারেশন করেন। সেই কারণেই এবার তাঁর কলকাতায় আসা। ২০২২এ ভারত সরকার ডা: দাশগুপ্তকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবদন্তি এই শল্য চিকিৎসককে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেন। আমন্ত্রিত ছিলেন সাংবাদিকেরাও। সম্বর্ধনার

উত্তরে শল্য চিকিৎসক প্রকার দাশগুপ্ত জানান, পেশাগত কারণে বিদেশে থাকলেও তাঁর কোলকাতার সঙ্গে রয়েছে নাড়ির টান। কেননা তিনি চিকিৎসক হয়েছেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে। পদ্মশ্রী সম্মান পওয়ার পর কলকাতায় এসে প্রথমেই গেছেন তাঁর পীঠস্থান কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ডাক্তারি শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠানে। ডা; প্রকার দাসগুপ্তের জন্ম মামার বাড়ি লখনউতে। শৈশবের দিন কেটেছে মামার বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে আর রামলীলা শুনে। পড়াশুনো রাউরকেল্লার সেন্ট পলস্ স্কুলে। সেখান থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। ইচ্ছে ছিল হাভার্ড কলেজে পড়ার। সুযোগও মিলেছিল। কিন্তু পিতামহ ছিলেন ডাক্তার। তাই পারিবারিক চাপ আর এক অভিভাবকসম শিক্ষকের ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়া।
শল্য চিকিৎসায় বিভিন্ন বিষয় থাকতে তিনি ইউরোলজি কেন বেছে নিলেন এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে ডা: প্রকার দাশগুপ্ত জানালেন, তাঁর এক আত্মীয়ের জটিল কিডনি ও প্রস্রাব সংক্রান্ত জটিল রোগ দেখেই সিদ্বান্ত নেন, এই বিষয়েই পড়াশুনো করব। আজ নিঃসন্দেহে ইউরোলজি বিভাগে বিশ্বের সেরা শল্য চিকিৎসকের তালিকায় প্রকার দাশগুপ্তের নাম ঘোষিত হয়। দেশ ছেড়ে তিনি ব্রিটেনের গাইস হসপিটালে প্রথম যোগ দেন। এরপর ২০০২ সালে কিংস হেল্থ এ। ২০০৯ এ পান প্রথম স্বীকৃতি। ইউরোলজি কিংস কলেজ ভাট্টিকুটি ইনস্টিটিউট অফ রোবোটিক সার্জারির চেয়ারম্যান হন তিনি। ডা : দাশগুপ্ত জানান,আমেরিকায় এখন ইউরোলজি সমস্যায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে রোবোটিক সার্জারি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রোস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রোবোটিক সার্জারি এত নিখুঁত হয়,যে পুনরায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। তবে রোবোটিক সার্জারি হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রথম করা হলেও অপারেশনের জটিলতা বেশি থাকায় হৃদ রোগে রোবোটিক সার্জারি আনুপাতিক হারে বিশ্বে কম। ভারতেও এখন প্রায় একশোটি রোবোটিক প্রযুক্তি বিভিন্ন হাসপাতালে এলেও প্রথম এই প্রযুক্তির ব্যবহারের কৃতিত্ব কিন্তু অ্যাপেলো হসপিটালের। ডা: দাশগুপ্ত আরও জানান,এখন নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিতে রোবোটিক সার্জারিতে ছ’টির পরিবর্তে মাত্র একটি ছোট্ট ছিদ্র করেই অপারেশন সম্ভব হচ্ছে। আগে এই মেশিনের দাম ছিল ২০;কোটি টাকা। এখন ৫ কোটিতেই মিলছে। রোবোটিক সার্জারির সুবিধা বুঝে যত অপারেশনের সংখ্যা বাড়বে, মেশিনের চাহিদা বাড়বে। দাম কমবে। সুবিধে হবে রোগী ও তাঁর পরিবারের। কেননা কমবে চিকিৎসা খরচ। রোবোটিক সার্জারিতে যেহেতু নামমাত্র রক্তপাত, তাই রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। হাসপাতালে থাকার দিন কম , খরচও কম। বাড়ি ফিরেও অপারেশন পরবর্তী সমস্যাও কম হয় রোগীর। হাসপাতালের অন্যতম মুত্র সংক্রান্ত চিকিৎসক ডা: অমিত ঘোষ জানালেন, অ্যাপেলো’র প্রাণপুরুষ
ডা: প্রতাপ সি রেড্ডি হাসপাতালকে সবসময় আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে জোর দেন। তিনিই এদেশে প্রথম অগ্নিমূল্য রোবোটিক সার্জারির দি ভিস্তা প্রযুক্তি কিনে আমাদের দেন।আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এতো মহার্ঘ প্রযুক্তি ব্যবহার আর্থিক দিক থেকে কতটা বাস্তবোচিত হবে? তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে রোগী পরিষেবা ব্যাহত হবে। আর্থিক ক্ষতি প্রথমে মানতে হবে বৃহত্তর স্বার্থে। ফলে তাঁর নেতৃত্বে আমরা অনুপ্রাণিত। হাসপাতালের তরফে পদ্মশ্রী ডা: প্রকার

দাশগুপ্তের হাতে ফুলের তোড়া ও মানপত্র তুলে দেন হাসপাতালের পূর্বাঞ্চলের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক রানা দাশগুপ্ত। সাংবাদিক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে ডা : প্রকার দাশগুপ্ত ছুটলেন এই হাসপাতালের ৭৫ বছর বয়সী এক রোগীর মুত্রথলির ক্যান্সার অপারেশন করতে। মনে পড়ছিল, আইজ্যাক অসি নভের কথা। রাশিয়ান তথা পরবর্তী কালে আমেরিকার নাগরিকত্ব নেওয়া লেখক ও কল্প বিজ্ঞানের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব,যিনি ছিলেন বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানের বই লিখেছিলেন প্রায় পাঁচশ। পুরষ্কারও পেয়েছেন অনেক। তাঁর রচনার অন্যতম ফাউন্ডেশন সিরিজের গল্প লাযার। যেখানে রোবোটিক্স এর তিনটি আইন নিয়ে এক কাল্পনিক যন্ত্রমানব নির্মাণ বিদ্যা পজিট্রনিক এর কথা উল্লেখ করেছিলেন।রোবোটিক্স শব্দের উদ্গাতাও তিনি। লেখার সময়কাল সম্ভবত ১৯৪০/৪২। অর্থাৎ মাত্র ৭৮ বছর আগের শুধু তাঁর কল্পনা যে বাস্তবিক হয়ে উঠবে একথা হয়তো তিনি ভেবেও দেখেননি।b১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল তিনি চলে গেছেন। বেঁচে থাকলে তিনি হয়ত তাঁর কল্পনার রোবোটিক্স বাস্তবে রূপ পাওয়ায় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম সেটির চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহারের দাবিদার বঙ্গ সন্তান পদ্মশ্রী ডা: প্রকার দাশগুপ্তকে নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করতেন।